[প্রতিদিন টিফিনের অবসরে বই পড়ে শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ বই নিয়ে বাড়ি যায়। বই পড়ার অভ্যাস, জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মিলছে নির্মল আনন্দ।]
গল্পের কোনো এক মজার চরিত্রে বুঁদ হয়ে হাসাহাসি করছে তারা। সে শব্দই জানালার ফাঁক গলে ছড়িয়ে পড়েছে বারান্দায়। সম্প্রতি এক দুপুরের এই চিত্র গাজীপুরের কাপাসিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
শুধু কাপাসিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, শিশু-কিশোরদের জ্ঞানচর্চা বা ছোট থেকেই বইমুখী করতে স্থানীয় সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির উদ্যোগে উপজেলার ৮৯টি বিদ্যালয়ে (প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক) রাখা হয়েছে বই পড়ার এমন আয়োজন। প্রতিদিন টিফিনের অবসরে এসব বই পড়ে শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ বই নিয়ে বাড়ি যায়। এতে বই পড়ার অভ্যাস, জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মিলছে নির্মল আনন্দ।
যেভাবে শুরু
১৯৯৮ সালের কথা। সিমিন হোসেন রিমি তখন সংসদ সদস্য নন। থাকেন ঢাকায়। কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে যেতেন নিজ উপজেলা কাপাসিয়ার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন। একটা সময় লক্ষ করলেন, মূল পাঠ্যের বাইরে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান কম। পাঠ্যের বাইরে তাঁদের কোনো বই নেই বা থাকলেও পড়ে না। বিষয়টি সিমিন হোসেনকে ভাবায়। এরপর তিনি নিজেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ শুরু করেন। একপর্যায়ে লক্ষ করেন তাঁর দেওয়া বইগুলো শিক্ষার্থীরা পড়ছে। বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। এরপর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে উদ্যোগ।
কাপাসিয়ার বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন বলেন, ‘ছোটবেলায় মা–বাবার সঙ্গে নিয়মিত বইয়ের দোকানে যেতাম। ঘুরে ঘুরে পছন্দের সব বই কিনে পড়তাম। তাতে নির্মল আনন্দ খুঁজে পেতাম। একপর্যায়ে মনে হলো ছোটবেলায় বই পড়ে আমরা যে আনন্দটা পেয়েছি, যে জ্ঞান অর্জন করেছি, তা থেকে বর্তমান শিশুরা অনেক পিছিয়ে। বিশেষ করে গ্রামের শিশুরা। পাঠ্যের বাইরে তাদের বই পড়ার সুযোগ কম বা বই পড়ে না। সেই ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগের শুরু। বই আমাদের পরম বন্ধু। যারা বই পড়ে, তারা সব জায়গায় ভালো করে।’
সরেজমিনে একদিন
কাপাসিয়ার ১১টি সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয় ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। প্রতিটি বিদ্যালয়েই দেখা গেছে, বই পড়ার এই কার্যক্রম। প্রতিদিন টিফিনের অবসরে শিক্ষার্থীরা বই নিয়ে বসে। পাশাপাশি পড়ার জন্য কেউ কেউ বই নিয়ে বাড়ি যায়।
দেখা যায়, বইগুলো দেওয়া হয় দুই ভাগে। প্রাথমিকে তৃতীয় থেকে পঞ্চম এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। প্রতিটি বিদ্যালয়েই একজন নির্দিষ্ট শিক্ষককে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি একটি নিবন্ধন খাতা অনুসরণ করেন। আগ্রহী শিক্ষার্থীরা নিবন্ধন খাতায় স্বাক্ষরের মাধ্যমে বই বাড়ি নিয়ে যেতে পারে। পড়া শেষে আবার বই জমা দিতে হয় স্কুলে। গল্প, রূপকথা, শিশুতোষ কাহিনি, মনীষীর জীবনী, ইতিহাসসহ প্রায় ২০–২৫ প্রকার বই রয়েছে।
ভুলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন টিফিনের অবসরে ক্লাসে এবং প্রতি বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছ থেকে বই নিয়ে যায়। পাশাপাশি আমরাও ক্লাসে পড়ে শোনাই। মূল বইয়ের বাইরে এসব বই পেয়ে শিক্ষার্থীরা খুবই খুশি। এসব কারণে তাদের পড়াশোনার প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে।’
নেওয়া হয় পরীক্ষা, দেওয়া হয় পুরস্কার
শিক্ষার্থীদের বই পড়ানোর কার্যক্রমটি পরিচালিত হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আহমদ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিবছর দুই ঘণ্টার একটি মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখান থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারীদের সনদ, নগদ টাকা ও বই উপহার দেওয়া হয়। পরীক্ষা হয় অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের যেকোনো দিন।
ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, মূল্যায়ন পরীক্ষায় ২০১৭ সালে উপজেলার ২২টি স্কুল থেকে ১০ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ২০১৮ সালে ৪৪ স্কুল থেকে ১৫ হাজার, ২০১৯ সালে ৪৯ স্কুল থেকে ১৮ হাজার এবং ২০২২ সালে ৮৯টি প্রতিষ্ঠান থেকে ২৩ হাজার ৫৪২ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। করোনায় ২০২০ সালে বন্ধ ও ২০২১ সালে সংক্ষিপ্ত আকারে পরীক্ষা নেওয়া হয়।
ফাউন্ডেশনের সংগঠক ও সিমিন হোসেন রিমির বিশেষ সহকারী পারভেজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বই পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক স্কুল এখন নিজ থেকেই এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে চাচ্ছে। এটা বিরাট সাফল্য।’
খুশি অভিভাবকেরা
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, বিষয়টি নিয়ে শুরুর দিকে তাঁরা কিছুটা বিরক্ত ছিলেন। কারণ, তাঁদের সন্তানেরা ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে এসব বই নিয়ে পড়ে থাকত। কিন্তু এখন তাঁরা দুটোই করছে। বরং বই পড়া কার্যক্রমের কারণে টিভি বা ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্তি কমেছে। ক্লাসের পড়া না থাকলে টিভি বা মুঠোফোন না চালিয়ে এসব বই পড়ছে।
উপজেলার দিঘধা গ্রামের বাসিন্দা মোসাম্মত আকলিমা বলেন, ‘আগে স্কুলের বন্ধ সময় বা ক্লাসের পড়া না থাকলে মেয়ে বাসায় বসে টিভি, না হয় মোবাইলে ইন্টারনেট চালাত। কিন্তু এখন সেই প্রবণতা নেই। অবসরে বাসায় বসেও বই পড়ে। এটা দেখে আমাদেরও ভালো লাগে।’
কার্যক্রমের বিষয়ে কথা হয় জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘শিশুদের ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা গেলে তারা অনেক কিছু জানবে, বুঝবে ও শিখবে। আমরা এ ধরনের কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই।’ মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকা সুলতানা বলেন, এটা খুবই প্রশংসনীয় কাজ। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর আকর্ষণ কমছে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ প্রথম আলো