‘দেখো না আন্টি, ও না সারাক্ষণ আমাকে কপি করে,’ আহ্লাদী কণ্ঠে বন্ধু জারিয়াতকে দেখিয়ে অভিমানের সুরে বলছিল পাঁচ বছরের মাহমুনা। জারিয়াতও কম যায় না। একইভাবে মাহমুনাকে নকল করে একই ভঙ্গিতে কথাগুলো নকল করে সে। শুরু হয়ে যায় দুজনের খুনসুটি। তবে সেই খুনসুটি আবার বন্ধুত্বে পরিণত হতেও খুব বেশি সময় নেয় না। কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় দুজনই আবার একসঙ্গে মেতে উঠেছে খেলাধুলায়। মতিঝিলের পুষ্পিতা ডে কেয়ার সেন্টারে (দিবাযত্ন কেন্দ্র) এমনি হাসি–আনন্দের মধ্যে দিন পার করে ওরা।
মতিঝিলের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এই ডে কেয়ার সেন্টার। ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই ডে কেয়ার সেন্টারের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। মতিঝিলে প্রধান কার্যালয় আছে, এমন ২১টি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত মায়েরা তাঁদের সন্তানকে এখানে রাখতে পারেন। সন্তানের বয়স হতে হবে ছয় মাস থেকে সাত বছর। মা অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, কিন্তু বাবা তালিকায় থাকা ২১টি ব্যাংকের যেকোনো একটিতে কাজ করলেও তিনি চাইলে সন্তানকে এখানে রাখতে পারবেন।
প্রতিষ্ঠানটির কো–অর্ডিনেটর রাকিবা খান বলছিলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টায় শুরু হয় কার্যক্রম। দিন ধরে ধরে আলাদা রুটিন। আসার পরই প্রত্যেককে সকালের নাশতা করানো হয়। এরপর থাকে শিশুদের নানা ধরনের কর্মকাণ্ড। খেলাধুলার পাশাপাশি বয়স অনুযায়ী ছবি আঁকা, ছড়া শেখানোসহ নানা ধরনের প্রি স্কুলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর ন্যানিরা বাচ্চাদের গোসল করিয়ে দেন। গোসলের পর দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুম। বিকেলে থাকে শারীরিক তৎপরতা। এরপর হালকা নাশতা। অফিস শেষে সাতটার মধ্যে মা–বাবারা এসে তাঁদের নিয়ে যান। এই হলো এখানকার শিশুদের নিত্য রুটিন।
গত রোববার মতিঝিলের দিলকুশার আল আমিন সেন্টারে অবস্থিত এই ডে কেয়ারটি ঘুরে দেখা গেল, বেশ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। শিশুদের দেখাশোনার জন্য এখানে আছেন ১১ জন ন্যানি, শিক্ষক আছেন ৫ জন। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক ও সমন্বয়ক হিসেবে আছেন দুজন। ৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই ডে কেয়ারের প্রতিটি দেয়ালকে সাজানো হয়েছে শিশুর মনের মতো করে। ঘরগুলোর পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ছয় মাস থেকে দেড় বছর বয়সী শিশুদের জন্য আছে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা। সেখানে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ন্যানিদের তত্ত্বাবধানে শিশুদের দেখভাল করা হচ্ছে। খেলাধুলার ব্যবস্থা তো আছেই, পাশাপাশি শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজনও করা হয়। বিজয় দিবস, পয়লা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারির মতো উৎসবগুলো শিশুদের নিয়ে পালন করা হয়।
ডে কেয়ারেই সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা জিনাত আরা বেগমের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, ছয় মাস থেকে সন্তানকে এখানে রাখতে শুরু করেছেন। এখন তার বয়স তিন বছর। আরেক অভিভাবক অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখার সিনিয়র কর্মকর্তা রওশন আক্তারের সঙ্গে দেখা। দুপুরের খাবারের বিরতিতে ছয় মাসের বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করাতে এসেছেন তিনি। বড় সন্তানকেও এখানে রেখে যান, ‘বাসায় বাচ্চাকে দেখাশোনার কেউ নেই। আর কাজের লোকের কাছে বাচ্চাদের সঠিক গ্রুমিংটাও হয় না। সে কারণে এখানে দেওয়া। বাচ্চা কখন কী খাবে, অসুখ হলে কী করবে, সবকিছুতেই সবাই এখানে বেশ দক্ষ। যে কারণে বাচ্চা অসুস্থ থাকলেও খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। ওষুধপথ্য ঠিকমতো বুঝিয়ে দিয়ে গেলে তারাই বাকিটা করে।’
কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে তারা সার্বক্ষণিক বাচ্চাদের কার্যক্রম দেখতে পারেন। যে কারণে এখানে শিশুকে রেখে তাঁরাও নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন। এখানকার ঘরোয়া পরিবেশ শিশুদেরও বেশ আকৃষ্ট করে বলে জানালেন তাঁরা।
আমরা থাকতে থাকতেই শিশুদের ঘুম ভাঙল। দুজন মিসের তত্ত্বাবধানে ওয়ার্কআউট শুরু হলো। গানের তালে তালে বেশ আনন্দের সঙ্গে চলে এ অনুশীলন।
পুষ্পিতা ডে কেয়ার সেন্টারে ইনচার্জ হিসেবে কাজ করছেন মেরিনা আক্তার। বলছিলেন, একসঙ্গে এতগুলো বাচ্চার দেখাশোনা করা বেশ ধৈর্যের ব্যাপার। তবে দিন শেষে ওরা যখন আনন্দ নিয়ে মিস বলে জড়িয়ে ধরে, এ অনুভূতি সত্যিই প্রকাশ করার নয়।
কথা হচ্ছিল বেসরকারি ব্যাংকসমূহের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সভাপতি ও যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। মতিঝিলে সরকারি ব্যাংকগুলোতে যখন ডে কেয়ার সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়, সাবেক গভর্নর তখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোকেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। যেহেতু বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় মতিঝিলে, প্রথম উদ্যোগটা তাই সেখানেই নেওয়া হয়। এই ডে কেয়ার সেন্টারে ব্যাংককর্মীদের আর্থিক সামর্থ্যের দিকটিও বিবেচনায় রাখা হয়। বর্তমানে পুষ্পিতা ডে কেয়ারের ৭০ ভাগ খরচ বহন করছে মতিঝিলে প্রধান কার্যালয় আছে এমন ২১টি বেসরকারি ব্যাংক, বাকি ৩০ ভাগ বহন করে এখানে সন্তান রাখতে আসা অভিভাবক।
শুরুর দিকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যখন যে ব্যাংকের কর্মীরা ডে কেয়ারে তাঁদের সন্তান রাখবেন, শুধু তখনই সেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ডে কেয়ারে টাকা দেবেন। পরে ঠিক হয়, সব ব্যাংক কর্তৃপক্ষই মাসিক নিয়মিত একটা টাকা এই ডে কেয়ারে দেবেন। ভবিষ্যতে নিজস্ব ভবনে এই পুষ্পিতা ডে কেয়ার শুরু করার কথা ভাবছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ প্রথম আলো