[ না বুঝেই বড়দের বিনোদনে শিশুদের অভ্যস্ত করছি আমরা। অথচ শিশুদের জন্য দরকার সঠিক শিশুতোষ বিনোদন। তাদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন বিনোদনের বিকল্প নেই। লিখেছেন সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির বিভাগীয় প্রধান শিক্ষক স্মিতা দাস]
শিশুরা হিন্দি-বাংলা সিরিয়াল দেখছে, যেটা মোটেই কাম্য নয়। আমরা অনেকেই আবার শিশুদের হিন্দি গানের গুনগুন আর নাচ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি! অথচ এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল মোটেই শুভকর কিছু নয়। এসব সিনেমায় শিশুদের জন্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্য ও সংলাপ থাকে। আবার হরর কিংবা সাইকো থ্রিলার সিনেমা দেখে তাদের শিশুমনে ট্রমা হতে পারে। তবে শুধু শিশুদের এমন বিনোদন থেকে দূরে রাখলেই সমস্যার সমাধান হবে না। তার জন্য চাই সুস্থ শিক্ষামূলক বিনোদন। সেই বিনোদন মোবাইল ফোনে ইউটিউবের কার্টুন কিংবা অ্যানিমেশন ছবি না। যেখানে সে দিনভর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবে। তাকে ডাকলেও সারা দেবে না, কোথাও খেলতে বা ঘুরতে যাবে না। চোখ সারাক্ষণ আটকে থাকবে স্ক্রিনের জাদুতে। টিভিতে, কম্পিউটারে, মোবাইলের স্ক্রিনে অভ্যস্ত হচ্ছে আমাদের শিশুরা। এভাবেই ভুল বিনোদনের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে শিশুদের শৈশব।
ক্ষতিকর দিক
সিরিয়াল ও সিনেমা দেখে অসংগতিপূর্ণ সংলাপ ও গান আউড়াচ্ছে শিশুরা। শিখছে হিংসা, বিদ্বেষ ও রেষারেষি। টিভি বা মোবাইল স্ক্রিন ছাড়া শিশুদের খাওয়ানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। ভিডিও গেম ও মুভি দেখে মারামারি, সহিংসতা অনুকরণ করছে। এতে কখনো ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। স্বাভাবিক মনোযোগ হারাচ্ছে শিশুরা। যার প্রভাব পড়ছে একাডেমিক ক্ষেত্রে। বই পড়া, খেলা বা অন্য যেকোনো কাজ মন দিয়ে করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সামাজিক মেলামেশায় অক্ষম হচ্ছে বেশির ভাগ শিশুই। রাগ বেড়ে যাচ্ছে, মানসিক ও আচরণগত অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। লিঙ্গবৈষম্যপূর্ণ আচরণ শিখছে। হিন্দি তো বটেই, বাংলা ও ইংরেজি বিনোদন মাধ্যম থেকেও বাচ্চারা প্রতিনিয়ত এসব শিখছে। শিশুদের বিশ্লেষণধর্মী ক্ষমতা ও কল্পনাশক্তি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। সারা দিন মোবাইল স্ক্রিনে সময় কাটানোর কারণে কায়িক পরিশ্রম কম হচ্ছে। তাই বেশির ভাগ শিশুর সঠিক শারীরিক বিকাশ হচ্ছে না। ওবেসিটির মতো সমস্যা বাড়ছে। আবার, শ্রম কম হয় বলে শিশুদের খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হয়। ফলে পুষ্টির ঘাটতি হচ্ছে শরীরে।
করণীয়
প্রথমেই শিশুদের স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। প্রথম এক সপ্তাহ দশ মিনিট, এর পরের সপ্তাহ আরো দশ মিনিট—এভাবে আস্তে আস্তে কমাতে হবে। সঙ্গে বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। শিশু কী দেখবে আর কী দেখবে না, তা সুচিন্তিতভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এড়াতে হবে অশ্লীলতা, সহিংসতা, লিঙ্গবৈষম্যমূলক বিনোদন উপকরণ। বাড়াতে হবে নির্মল বিনোদন ও শিক্ষণীয় উপকরণ। পরিবারের সবাই মিলে শিশুকে সময় দিতে হবে, গল্প করতে ও খেলতে হবে তার সঙ্গে। শিশুর বয়স উপযোগী খেলা খেলতে হবে তার সঙ্গে। এমন সব খেলা তালিকায় রাখতে হবে, যা বুদ্ধি, কল্পনাশক্তি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, কায়িক শ্রম, অন্যের সঙ্গে যোগাযোগে বাচ্চাদের উত্সাহিত করে। এমন খেলা হতে পারে দাবা, টাং টুইস্টার, হুইস্পারিং গেম, দড়িলাফ ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দলবদ্ধ খেলা খেলতে অভ্যাস করান। এতে যোগাযোগ করার ক্ষমতা বাড়বে। স্বতঃস্ফূর্ততা আসবে তার মধ্যে। ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরে, যেখানে বাইরে খেলার জায়গা কম সেখানে বাচ্চাকে কারাতে, জুডো, যোগব্যায়াম, সাঁতার—এমন কিছু করতে দিন। এসব কিছুর পাশাপাশি বাড়ির বড়দেরও বিনোদনেও সচেতন হতে হবে। শিশুদের সামনে সিরিয়াল, হরর, থ্রিলার বা শিশু উপযোগী নয়—এমন বিনোদন এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এমনকি শিশুদের সামনে এসব বিষয়ে আলোচনা না করাই শ্রেয়। এতে ওসব বিষয়ে শিশুদের কৌতূহল জন্মাবে। শিশুদের মধ্যে ছোট থেকেই বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারেন। বই পড়ার চেয়ে ভালো অভ্যাস আর কিছু হতে পারে না। যেকোনো বিষয়ে শিশুদের ভালোভাবে কাউন্সেলিং করতে হবে। মা-বাবা ও পরিবারের বড়দের কাউন্সেলিং কচি মনগুলোকে আনতে পারে সুন্দর সুপথে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ কালেরকন্ঠ