আর কে চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদঃ রাজধানী ঢাকা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। কালের বিবর্তনে সেগুলো আজ অপদখলের শিকার। একসময় যেসব মাঠে ছিল ফুটবল নিয়ে শিশু-কিশোরদের অনুশীলন, যেসব পার্কে ঘোরাফেরা করে মুক্তবায়ু সেবনের সুযোগ পেত এলাকার মানুষ, সেগুলো এখন অপদখলের শিকার। শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের প্রয়োজন সুস্থ, সুন্দর ও আনন্দময় জীবন। আর এ জন্য খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলা। এ জন্য প্রয়োজন খেলার মাঠ। খেলাধুলা চর্চার প্রতি শিশু-কিশোরদের সব সময়ই আগ্রহ থাকে। তারা খেলাধুলা করতে চায়। ভালো পরিবেশে খেলাধুলা করতে পারলে তাদের পড়ালেখার প্রতিও মনোযোগী করে তোলা যায়। একটা সময় ছিল যখন মাঠ বা স্কুল-কলেজের খেলার চত্বর মুখর থাকত। এখন তেমনটি খুব একটা চোখে পড়ে না। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে পুরনো কিছু স্কুল-কলেজ ছাড়া নতুন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, সিরাজগঞ্জে ৫২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো খেলার মাঠ নেই। একই অবস্থা কিন্ডারগার্টেনগুলোতেও। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জেলার ৯টি উপজেলায় ১ হাজার ৬৭১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও ৫২১টিতেই নেই খেলার মাঠ। তবে এই চিত্র যে শুধু সিরাজগঞ্জের এ কথা বলা যাবে না, তা প্রায় সর্বত্র বিরাজমান। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজের মাঠে খেলাধুলার পরিবর্তে চলে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা ক্ষমতার জোরে দখল করেই চলেছে একের পর এক মাঠ। এ অবস্থায় যে লোভের সংস্কৃতির জন্ম হচ্ছে, এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। সবার লোভের দৃষ্টি যেন স্কুলের ওই সবুজ মাঠটি ঘিরে। অথচ যা হওয়ার কথা ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সহায়ক, তা যেন দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। স্কুল থাকবে, মাঠ থাকবে না, শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতে পারবে না- এটা কি ভাবা যায়? মাঠের অভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার চর্চা নেই, নেই সাংস্কৃতিক পরিবেশ। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কোনোভাবে কাম্য নয়।
বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে বেসরকারি পর্যায়ে এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর কোনো খেলার মাঠ নেই। নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনায় খেলার মাঠকে বিনোদন ক্ষেত্রের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ তৈরির ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ভাবনা-চিন্তা খুবই স্বল্প। এই বাস্তবতায় খেলাধুলার সুযোগকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার মৌলিক অধিকার বিবেচনা করে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, কার্যকর বাস্তবায়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধু পাঠদানের মধ্যেই একটি বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যেসব চর্চার প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে হয়। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেই নিজস্ব কোনো খেলার মাঠ। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠের অভাব চোখে পড়ার মতো। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত কয়টি প্রাইভেট বিশ্ব^বিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস ও খেলার মাঠ আছে?
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে হাই স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, এমনকি বিভিন্ন শহরে স্টেডিয়াম নামধারী মাঠের ভেতরে ও বাইরে ছোট-বড় অংশ দখল, খেলাধুলার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কাজে এবং ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে যে লোভের সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, এর থেকে আর পরিত্রাণ মেলেনি। মাঠের অভাবে, সুস্থ পরিবেশের অভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলার চর্চা নেই, এটা নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা কি সংশ্লিষ্ট মহলের আছে? খেলার মাঠ দখল করে অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রম কোনোভাবেই ছলতে পারে না। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুতই এদিকে নজর দেয়া দরকার। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবার এখনই সময়। শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়ার ভালো পরিবেশের পাশাপাশি একটি ভালো মাঠের নিশ্চয়তা যেন দেয়া হয়, সেটাই আমাদের কাম্য।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ভোরের কাগজ